Sunday, 4 August 2019
দুগ্ধ ও সুরা : দ্বন্দ্ব
সুন্দরী মেয়েরা একটু নিষ্ঠুর না হলে চরিত্রে ঠিক নুন আসেনা।
পৃথা, দুধ প্রকৃতির। দুধ যেমন, সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর। যেন ঘুমন্ত
শিশুকাল। আধো গন্ধ। স্রোতের মতো সুবহ। মাতার মতো সহজ। তরলের মতো অনুগামী। আয়ত
চক্ষুদুটিতে রহস্য ঘনীভূত হবার সময় হয়নি এখনো। বাধ্য চক্ষুদুটি তার, স্পষ্ট, পূর্ণ
দৃষ্টি দেয়। দৃষ্টি গোপন করতে সে শেখেনি এখনো। শুধু মাঝে মাঝে নির্ভার কপালে তার,
ভ্রুমধ্যে সামান্য একটি ভাঁজ পড়ে।
পৃথা দুগ্ধবৎ, নুনবিহীন। তার কৃষ্ণাঙ্গী কিঙ্করীটি সাঙ্ঘাতিক। আত্রেয়
তার থেকে দূরত্ব রাখেন। এবং না, কন্দলীরও চরিত্রে নুন ছিলো না।
উত্তেজনার মুহূর্তে কন্দলীর উপরের ঠোঁট উঠে যেতো,
নাকের কাছে চলে যেতো আর তার দাঁত বেরিয়ে পড়তো বেশি করে। উঃ সেই কলহপ্রিয়া রমণী! আত্রেয়
দুর্বাসার চরিত্রে বিরক্তিবোধ স্থায়ী হয়ে যাবার মূলে সেই নারী।
সে নারী ধ্বংসও হলো। সে আর ভাবতে চান না আত্রেয়,
সেই প্রসঙ্গ মাথায় এলেই তাঁর ঘুমোতে ইচ্ছে করে। তারপর তো এই বিস্তীর্ণ আর্যাবর্ত। গ্রাম
অরণ্য জনপদ। জলাশয়। কখনো শিষ্যসহিত, কখনো একা। কখনো যতি হয়ে, কখনো পথিকমাত্র।
নাঃ কোন নারীকে আর নিজের সঙ্গে বাঁধেননি আত্রেয়। কোন নারীর সঙ্গে
নিজেকে বাঁধবার প্রশ্নই নেই।
কিন্তু রথের অপরদিকের চক্রটির সঙ্গে দূরত্ব রাখবারও তো উপায় নেই। সে
সমান্তরালে থাকবেই। থাকুক।
নৃপতিনন্দিনীরা,
রাণীরা যখন পদপ্রান্তে নত হয়, বিশেষ বৈলক্ষণ্য হয়না তাঁর। সে তো পথেঘাটে যে কেউই হয়।
কিন্তু অধিক সময় বিশ্রাম নিতে গেলে বিচিত্র ঘটনারও সম্ভাবনা হয়। বেশিদিন কোথাও থাকতে
নেই। অথচ এই কুন্তীরাজ্য থেকে আত্রেয় দূর্বাসার মন উঠে যেতে চাইছেনা এখনও।
পৃথা?
প্রশ্নটি নিজেকে করেই ভুলে যেতে চান আত্রেয়। মনে করতে থাকেন, কী কী কৃত্য বাকি আছে। কোথায় যেন যেতে হবে।
শিষ্যদের সঙ্গে কি যেন কথা হয়ে আছে ...
* *
* * *
*
-- তুমি
অস্থির রয়েছো?
-- না
আর্য। আদেশ করুন।
-- তোমার
কিঙ্করীরা কেউ আছে কাছাকছি?
-- না
আর্য। আমাকে বলুন, কি করতে হবে।
পৃথা তিরতির করে কাঁপছে, যদিও সংযত রয়েছে। সমীহ, না ভয়? মুনির সঙ্গে
দীর্ঘ দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে সে, কিন্তু সে ঘুমন্ত মুনি। সে সেবা করেছে, চলে গেছে
নীরবে, বিশ্রাম করেছে, আবার এসে সেবা করেছে। সে আলাদা মানুষ, সে শিশু। জাগ্রত মুনি
যেন এক অগ্নিপিণ্ড, তাঁর সঙ্গে এতক্ষন থাকতে তার ভয় হচ্ছে না অন্য কিছু সে জানে
না। যদিও শারদ অপরাহ্নে তার চোখ মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছে আকাশে। ত্রিভূমক
শ্বেতাবাসটির ছাদে পশ্চিমাস্য হয়ে বজ্রাসনে বসে রয়েছেন আত্রেয়, অদূরে নতজানু পৃথা।
-- সূর্যবন্দনা
করবো। আমার কমন্ডলু আনো।
-- যথা
আজ্ঞা আর্য।
নেমে যায় পৃথা। পা দু'খানি শিথিল লাগছে তার, কোমরে যেন জোর নেই,
হাতদুটি কাঁধের সঙ্গে যেন লেগে রয়েছে। অথচ দেরি হলে চলবেনা, কি কারণে কখন যে
ক্রোধিত হ'ন মুনি, তা দেব পশুপতিও বুঝি জানেননা!
-- গঙ্গোদক,
আর্য।
-- হ্যাঁ,
দাও।
আত্রেয় সূর্যবন্দনা করেন, পৃথা অপলকে আকাশ দেখে। অনেকদিন পর! ভেসে
যাওয়ার মতো বিকেল, মুনির মন্ত্রোচ্চারণ, পৃথা তিরতির করে কাঁপে।
-- আর্য,
আমি কি এই কৃত্য করতে পারি? আমাকে সূর্যবন্দনা শেখাবেন?
-- কি
প্রয়োজন পৃথে? আচার যতো বাড়াও ততোই বাড়ে। প্রয়োজন অধিক না হলে আচারে আবিষ্ট হওয়া অনুচিত।
-- আচারে
আবিষ্ট কেন বলছেন দেব?
-- আচার
অধিক কিছু দেয় না। মনকে একটি স্নান দেয়, সাময়িক। আচারটি অনুষ্ঠিত হবার পর নিজেকে শুদ্ধশূচি
বোধ হয়। বেশ কয়েকদিনের পর, সেই আচারই ভার মনে হতে পারে। অপরাধের ভয়ে তখন তা ছাড়াও যায়না,
শৃঙ্খলা শৃঙ্খলমাত্র হয়ে থেকে যায়।
অপরদিকে, কারো কারো আচারঅনুষ্ঠানে নেশা লেগে যায়। তখন আবার, সেই আচারটি
অনুষ্টিত না হলে তার মন খঞ্জ হয়ে থাকে। এটিই আবেশ।
-- আপনি
তো স্নানও বললেন প্রভূ।
-- বললাম।
-- আমার
কি স্নান হতে পারে না, প্রভূ?
-- পারে।
না-ও হতে পারে। হয়ে, পরে ভারও হতে পারে। সে ভার নিতে চাইছো কেন, পৃথে?
পৃথা জানেনা আজ তার কি হচ্ছে। অনেক কিছু হচ্ছে। এই শরীর সম্পূর্ণ শিথিল
হয়ে যাচ্ছে, একটু পরেই তার লাফাতে ইচ্ছে করছে! একটা কোন বাঁধ খুলে গেছে তার।
-- আমার
ভালো লাগে প্রভূ!
-- আঃ
সে তো সকলেরই লাগে! তারপর সেই নিগড়। তোমরা গৃহী। আচারের নিগড়ে না পড়াই শ্রেয়ঃ।
-- আমার
ভালো লাগে এই সব কৃত্য। যজ্ঞাদি পূজাবিধি ভালো লাগে। যতি মুনি ঋষিদের ভালো লাগে আর্য।
আপনারা কতো কতো স্থান পরিভ্রমণ করেন, আপনাদের পায়ে সেইসব ভূমির ধুলো লেগে থাকে আর্য।
আপনার পদপ্রক্ষালনের সময় সেই সব ধুলোর স্পর্শ পাই আর্য। আপনাদের গাত্রবস্ত্রে, সেই
সব স্থানের বায়ুর স্পর্শ থাকে। আমার তা আঘ্রাণ করতে ইচ্ছা হয় প্রভূ।
-- তুমি
আমাকে বিস্ময়াবিষ্ট করছো, পৃথে! এমন আমি কাউকে দেখিনি! আমাদের জীবন পথে। আমার ধূলিধুসরিত
দেহ, সমল বস্ত্র আর উগ্র দেহবাসে রাজ্ঞীরা, রাজনন্দিনীরা সন্মুখে শ্রদ্ধাবনত হলেও অন্তরালে
গিয়ে শুকরীর ন্যায় ওষ্ঠ বাঁকায়। তুমি সত্যিই এসবে বিতৃষ্ণা বোধ করোনা?
-- না
আর্য। নারী যতি হতে পারেনা নইলে আমি এই জীবন বেছে নিতাম। আপনি যখন শিষ্যসমাহিত হয়ে
আলোচনা করেন, আমি কখনো কখনো শুনেছি। হোম, যজ্ঞ,
পূজাবিধি, তীর্থমাহাত্ম্য -- রোমাঞ্চিত হই শুনে --
-- আর
কিছু শোনোনি?
-- শুনেছি
প্রভূ!
-- শুনেছো?
-- হ্যাঁ
প্রভূ! সবই শুনেছি।
-- তাও
তোমার ভালো লেগেছে? ভালো লাগে?
-- ভালো
লাগে প্রভূ! আর্যাবর্তের সর্বত্র আপনাদের অবাধ গতি --
-- শুধু
আর্যাবর্ত নয় পৃথে, আমি পদব্রজে উত্তরকুরু অবধি গিয়েছি। দেব হিমাদ্রির পাশ দিয়ে প্রথমে
ইলাবৃতবর্ষ, তারপর কিম্পুরুষবর্ষ পার করে উত্তরকুরু। প্রতিটি বর্ষই জনবিরল স্থান, দিনের
পর দিন মানুষের মুখ দেখতে পাওয়া যায় না, যদিবা পাওয়া যায় তাদের দেখে মানুষ বলে মনেই
হয়না। হ্যাঁ, আর্যাবর্তের সকল জনপদই আমার পরিচিত, কোনটি কবে গড়ে উঠলো, তা আমার চোখের
সন্মুখে দেখা!
-- আর্য,
আমি আপনার শিষ্যা হতে পারিনা?
-- কোনকালে
হয়তো এমন হতো, এখন তো তা হয়না পৃথে! এখন এরূপ রীতি নেই।
-- বানপ্রস্থে
তো যেতেই হয় এখনও। আমি যদি আপনার শিষ্যা হয়েই যাই, কেন তা সম্ভব নয় প্রভূ?
-- বানপ্রস্থে
সবাই যায়? যায়না পৃথে। অনেকে যায়। অনেকে যায়না। রীতি রয়েছে। আগের মতো তার সামগ্রিক
মান্যতা নেই।
-- কিন্তু
বনে কি নারীরা থাকতে পারেনা, আর্য?
-- পারে।
পুরুষ দেখানে থাকতে পারে, নারী কেনই বা সেখানে থাকতে পারবেনা? নিশ্চয়ই পারে। তপোবনে
মুনিপত্নীরা, ঋষিকন্যারা থাকেন না? থাকেন। কিন্তু তারা কারও না কারও দয়িতা বা বনিতা।
কারও পত্নী অথবা কারও কন্যা। শিষ্যা নয়।
-- আমাকে
আপনার কন্যার স্থান দিয়ে নিয়ে চলুন আর্য!
স্মিতহাস্যে পৃথার মুখের দিকে কয়েক পলক চেয়ে রইলেন আত্রেয়! এ কী
বিস্ময়বালিকা! এমন শূচিশুভ্র টলটলে মুখখানি, অপার বিস্ময়মাখানো চোখ, নারীত্বের ঘুম
ভাঙবার আগে বড়ো উন্মন, বড়ো উচাটন হয়ে আছে এই মেয়ে! তার সঙ্গে এই বাইরের প্রতি টান!
কখনো শান্তি পাবেনা এ মেয়ে, সারাজীবন এর কাটবে শান্তি আর অশান্তির মধ্যে যাতায়াত
করতে করতে।
সঠিক শাস্ত্রজ্ঞান একে দেওয়া গেলে এ পৃথিবী জয় করতে
পারে, শুধু সারল্যের ওপরে উঠতে হবে। ব্রাহ্মণদের মেয়েরা তো সরল হয়ইনা, রাজবংশের কোন
বালিকাই এই বয়স অবধি এত সরল থাকেনা। এই সারল্য এর মজ্জাগত!
পদদ্বয় কোথাও স্থির হয়না আত্রেয়র। নইলে বছর দুইতিন
সময় পেলে এই বালিকাটিকে শাস্ত্রজ্ঞান দিতে পারতেন। শিষ্যা হবার প্রধান গুণটি এর আছে।
মেয়েটি আজ্ঞাবহ।
-- তুমি
রাজনন্দিনী পৃথা! দিগ্বিজয়ী নরপতির সঙ্গে তোমার বিবাহ হবে, তোমার সন্তান সসাগরা পৃথিবীর
অধিপতি হবে, সেই তো তোমার জীবন! তুমি বানপ্রস্থে যেতে চাইছো?
-- আমার
পিতা যাদববংশীয় আর্যক শূর। তিনি আমার দান করেছেন তাঁর বন্ধু মহারাজ কুন্তীভোজের কাছে।
আজ কুন্তীভোজই আমার পিতা। আপনি আমায় কন্যা বলে গ্রহণ করলে আপনিই আমার পিতা। পিতার ধর্মেই
সন্তানের ধর্ম, নয় কি, প্রভূ?
-- হ্যাঁ,
তা তুমি ঠিকই বলেছো পৃথে! কিন্তু আমি সন্তানবাৎসল্য বিষয়ে স্বস্তিবোধ করিনা। বলা ভালো, ভয় পাই। মানুষ তার অরির সামনে পরাহত হয়না। পুরুষ
তার স্ত্রীর সামনেও অটুট থাকতে পারে। কিন্তু সন্তানের সামনে সকল মানুষই অসহায়। তাদের
হাত পা বেঁধে রাখে স্নেহ। এই স্নেহের বন্ধন থেকে আমি সযত্নে নিজেকে রক্ষা করে চলি,
পৃথে!
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment