Monday, 5 August 2019
সাইকেলের জন্য
“আপনাতে আপনি থেকো মন যেও
নাকো কারু ঘরে
যা চাবি তা বসে পাবি, খোঁজ
নিজ অন্তপুরে”- কথামৃত
একটা শৃঙ্খলের সাথে একটা শৃঙ্খল জুড়েই
মস্ত শেকল। যার দুদিকে দুটো আঙটা। আমি সাইকেলটাকে বেঁধে রেখেছি ওর ব্যক্তিগত তালা
নেই বলে। অথচ চাবির ডুপ্লিকেট ট্রিপলিকেট হয়। বাজারে যেতে যেতে মোবাইলটা বিপ বিপ
করে বন্ধ হয়ে গেলে,অন্ধকারে হুটার বাজিয়ে আসে নাগরিক শকুন। অজ্ঞাতসারে। খোঁজ...খোঁজও
পরজাতীয় সপ্তম মুদ্রা। মিথ্যে আর উপমার যাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আসা অবিবেচক রুটি। তৎক্ষণাৎ
মেশিনের অশ্বক্ষমতা মাপতে মাপতে রেশন দোকান থেকে ঠকিয়ে নেওয়া চাল,গম,লাল আটার
প্যাকেট তৃষ্ণা দিচ্ছে পাকস্থলীকে। আমার রেশন কার্ড দিয়েছি ক্ষুধাকে ও এখন
প্রতিমাসে রেশন তুলে খায়। আমার নামে ফুরনে কাজ করে। সবেতেই আমার নাম। আমার কীর্তন।
“কৃৎ” অর্থাৎ প্রশংসা। দুহাজার বর্গমাইল দূরে হাওয়ায় বীজ উড়ে যায়। জন্ম নেয় নতুন
গাছ। এ এক বিরাট অবদান। গাছের কাছে গাছের। মানুষের কাছে মানুষের। আধপচা নরম কাপড়
নিয়ে যায় অন্য মানুষ। আর রোদের দড়িতে ঝোলে নিঃসঙ্গ চামড়া। অথচ সাইকেলটা নির্বাক। ও
কিছু চায় না। আমি বেঁধে রাখলে বেঁধেই থাকে। যেন আমার হাতে ওর নোঙর। কিন্তু চাবির
ডুপ্লিকেট ট্রিপলিকেট হয়। মাঝে মাঝে রাগ বয়ে যায় ও নিজের নিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে চুপ
করে দাঁড়িয়ে থাকে। মাকড়সা বাসা করে ও হয়ে ওঠে জীবের আশ্রয়দাতা! নাইলন দড়িগুলো ওর
গলার কাছে নীল আর কমলায় আকৃতি নির্মাণ করে। পড়ে থাকে। কখনও টেনে নেয়না। জিজ্ঞেস
করতে চাই, একা ফেলে যেতে চায় কি না? ভাবি সসাগরার অর্থ জানতে চাইব। কিন্তু;অপারগ
বলে কোন শব্দ যখন দেখি ওর গলার বন্ধনী থেকে দুটো বল খসিয়ে ফেলে দেয়। গলাটা লুর লুর
করে। দড়িটার নীল রঙ ওর গলায় লেগে আছে?
-একা যেতে চায় না।
-চালকবিহীন
-নতমস্তক প্রভুরদ্বারে
এভাবে বংশগতির গড়ে একা। একটা শৃঙ্খল
থেকে আরেকটা শৃঙ্খল জুড়েই শেকল। অথচ জং ধরছে। পেডাল করা যাচ্ছে না অসম্ভব নিষ্ঠুর
চাকায়। ওকে থামাবার জন্য যে যন্ত্রবিদ অস্ত্র রেখেছিল সেও বিকল কারণ; বংশের
বিকলতা...অবক্ষয়। হাতুড়ির আওয়াজ কানে আসে না বেরিয়ে আসে হিংস্রতা যাকে আমি চিনি
গাছের জন্য গাছ আর মানুষের জন্য মানুষ হিসেবে। সেই হিংস্রতা। স্তম্ভের ভঙ্গিমায়
দাঁড়িয়ে এবার। গায়ে জল পড়ছে সাইকেলটার। যেভাবে দৈবাৎ জলে ভেজে পাগল সেভাবেই। বারান্দার
জলে। ওকে কি সারিয়ে তুলব? না বিক্রি করব লাভ-ক্ষতির শতাংশের হারে? ওর বহনযোগ্যতা
কি আমার মতো? এতগুলো প্রশ্ন আসলে মাথাটা ফুলে যায় না আসলে ফুলে ওঠে মস্তিষ্কের
পাৎলা মেমব্রেন তাই মাথাটাও ফোলা দেখায়। এবার আমার হাঁটু ঠেকে যাচ্ছে ওর হাতলে, বশবর্তী
হচ্ছি আমি ওর। একটা জড়ের আপাত সরলরৈখিক রিজিডিটির কাছে। আমাকে বলেছিল খোলবার
দর্শন- “ওর স্পোকগুলোর দিকে তাকাও” আমি তাকাইনি। এখন মাটির রক্ত শুকিয়ে ওর ধমনীর
মধ্যেকার পরিশ্রুত প্রবাহমাত্রার দিকে। আমি ওর বাহক। আমি ওর চালক একদা। অথচ ও
বুঝলো না আমার পঙ্গু হয়ে যাওয়া মন নিয়েও এত কথা লিখেছিলাম। শুধু ওকে গতি দিইনি। তুলে
দিইনি অন্ধ চালিকাশক্তির অন্তরায়ে। ও মরছে জং ধরে...আর কেউ স্বার্থপরতার নিঃসীম
শূণ্যে। গাছ নয়। মানুষ নয়।
মন আপনা আপনি থেকে চাইতে শিখেছে, শিখেছে
স্থিতাবস্থার পতিত জানুর উপভাষা।বুকের ভিতর বাজনা বাজে। বুক তবে কি অন্তঃপুর? আরেক
চাবির বিবেচনা?
এভাবে মানুষ দেখছি আমি। যে মানুষ প্রবল
নার্সিশাস সে আদৌ নয়। যে মানুষ কংক্রীটের ভিতর গোলাপ ফুটিয়েছে সে পাগল নয়, আসলে সে
জড় ভাবতে পারেনি আজও কিছুকেই। কেননা সম্পূর্ণ ইতিহাস বলে কিছু নেই। মানুষ
জন্মগ্রহণ করে আর সারাজীবন মানুষ হয়েই বাঁচে। আর জড়? যার মাথা থেকে অনর্গল রক্ত
বেরিয়ে যাচ্ছে, সে যেন বলছে 'একদিন কেউ আসবে যে এসে তোমাকে দেখাবে তোমার
সত্যিকারের মুখ।'
এখানেই আমি মিলিয়ে নিয়েছিলাম ওল্ড
টেস্টামেন্ট আর ‘কথামৃত'-র সমস্ত ভাষ্য। যেখানে জড় আর মানুষের ভেদাভেদ নেই।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment