।। আর
একটি প্রেমের কাহিনি ।।
পাঁচ
সন্তানের মধ্যে সবার ছোটো ক্যামিলা বড় আদরের সবার কাছে। তার বাবা আর্জেন্টিনার বুয়েনস
আইরিসের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। ক্যামিলা বড় হয়ে লুকিয়ে রাখা ঠাকুমার প্রেমপত্র
মাঝে মাঝে ঠাকুমাকে পড়ে শোনায়। রক্ষণশীল পরিবারে যে প্রেম মর্যাদা পায়নি। চিঠি পড়ে
ঠাকুমাকে স্মৃতির গভীরে নিয়ে যেত। ঠাকুমা আর নাতনি ছাড়া একথা পরিবারের কেউ জানত না।
রক্ষণশীল ক্ষমতাবান পরিবারে প্রেম বিষয়ক বই পড়াও নিষিদ্ধ ছিল। ক্যামিলা অবশ্য
লুকিয়ে ফরাসি প্রেমের উপন্যাস, গল্প পড়ত।
একদিন
ঐ অঞ্চলের চার্চে অল্পবয়সী এক ফাদার যোগ দিল। নাম লাডিসলাও। বংশমর্যাদায় খুব বড় পরিবারের
সন্তান। তার কাকা গভর্নর বলে ফাদার লাডিসলাওকে সাদরে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল
ক্যামিলার বাবা। বলেছিল, 'তোমার জন্য আমার বাড়ি অবারিত।'
সেবার ক্যামিলার জন্মদিনে ফাদার আমন্ত্রিত হয়ে এসেছে। ক্যামিলা তখন চোখে কাপড় বেঁধে
ছোটোদের সঙ্গে কানামাছি খেলছিল। একে তাকে ধরতে ধরতে হঠাৎ সেখানে আমন্ত্রিত ফাদার লাডিসলাও
এসে পড়ায় চোখ বাঁধা অবস্থায় ফাদারকে জড়িয়ে ধরলো। ফাদার তখন ইতস্তত! ক্যামিলা বুঝল,
কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। চোখ খুলল। সেই প্রথম চার চক্ষু এক হলো। ক্যামিলার মনে ফাদার
জায়গা করে নিয়েছে। ফাদার লাডিসলাওয়ের ক্যামিলাকে ভালো লাগলেও সে আমল দিল না। দিতে চাইল
না। বা বলা যেতে পারে তার এ ব্যাপারে দুর্বল হওয়া ঠিক হবে না। সে যে ফাদার!
কিন্তু
চাইলেই কি আর
মন থেকে তাড়ানো যায়! ভালোবাসা কারও পেশা দেখে আসে? যতই দূরে সরাতে চায় ততই মনের মধ্যে
চেপে বসতে থাকে। নিস্তার পেতে নিজেই নিজের পিঠে চাবুক মেরে ক্ষতবিক্ষত করে। তবুও মন
থেকে সরাতে পারে না ক্যামিলাকে।
ক্যামিলার
সবচেয়ে প্রিয় ঠাকুমা অচিরেই চির বিদায় নিলেন। তাঁর কফিনে মন্ত্রপাঠ করতে আসার কথা ফাদার
লাডিসলাওয়ের, কিন্তু সে আসেনি। ক্যামিলার মনে উদ্বেগ। কফিনের পাশে সবাই দাঁড়িয়ে। অন্য
এক ফাদারের আগমন দেখে ক্যামিলার বাবা ছোটো ছেলের কাছে জানতে চাইলেন, কেন ফাদার লাডিসলাও
এল না? চাপা গলায় ছেলে জানাল, ফাদার অসুস্থ।
কথাটা কানে গেল ক্যামিলার। স্থির থাকতে পারলা না। ঠাকুমার জন্য আনা গোলাপ কফিনের ওপর
রেখে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল সে। মেয়ের বেরিয়ে যাওয়ায় বাবা একটু চিন্তিত হলেও তেমন কিছু
ভাবলেন না।
ক্যামিলা
গোপনে কালো কাপড় ঢেকে ছুটে গেল ফাদারের ডেরায়। ফাদার খুবই অসুস্থ। শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে।
মাথায় পট্টি দেওয়া। ক্যামিলা ফাদারের মাথায় হাত রাখল। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য করল
তার দেওয়া সাদা রুমাল বুকে নিয়ে শুয়ে রয়েছে ফাদার। ক্যামিলা আস্তে আস্তে ফাদারের ওষ্ঠে
চুম্বন করলো। ঘোরের মাথায় ফাদার জানেইনি ক্যামিলা তাকে চুম্বন করেছে।
কয়েকদিন
বাদে সুস্থ হওয়ার পর ফাদার দু লাইনের একটা চিঠি পেল। ক্যামিলা তাকে নদীর ধারে এক নির্জনে
দেখা করতে বলেছে। সে গেল। ঝোপের আড়াল থেকে দেখল ক্যামিলা অপেক্ষা করছে, কিন্তু দেখা
না করে ফিরে এল।
তা বলে কি সে ক্যামিলাকে অস্বীকার করতে পারল? না। আরও দৃঢ়, গাঢ় হল দুজনের প্রেম।
এদিকে
বাবা তাঁর পছন্দের পাত্রের সঙ্গে ক্যামিলার বিয়ের ব্যবস্থা করার তোড়জোড় শুরু করেছেন। প্রচণ্ড প্রভাবশালী জেদি মানুষটির ধারণা নারীরা
বিয়ে, ঘর সংসারই করবে। তার বেশি কিছু নয়। স্ত্রী, কন্যা কাউকে পাত্তা না দিয়ে নিজের
পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করার জোর করতে লাগলেন।
ক্যামিলা
বুঝল তার দোর্দণ্ড বাবার হাত থেকে বাঁচতে গেলে, প্রেম বাঁচাতে গেলে তাদের পালাতে হবে।
সেই মতো নিজের গয়না, সামান্য কিছু জিনিস নিয়ে একদিন রাত্রে সে
ফাদারের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। ফাদার আগে থেকেই ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বুয়েনস
আইরিস থেকে বহুদূরে প্রায় ব্রাজিলের কাছাকাছি এক জায়গায় তারা আশ্রয় নিল এক ছোটো শহরে।
এদিকে
তাদের পালাবার খবর বাবার গোচরে আসায় গভর্নরের মাধ্যমে সারা দেশে ওদের নামে পরোয়ানা
জারি করে ছড়িয়ে দেওয়া হল। হন্যে হয়ে পুলিশ খুঁজছে। দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার। ধরিয়ে
দিলে মিলবে ইনাম।
মোটামুটি
ভালোই চলছিল ক্যামিলাদের নতুন সংসার। ফাদার ছোটো একটা স্কুলে পড়াত। আশপাশের লোকজনের
সঙ্গেও খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এতোই সোজা! এতোই সহজে ছেড়ে দেবে সমাজ? একদিন এক পার্টিতে ফাদারকে চিনে ফেলল
একজন।
অচিরেই ধরে নিয়ে যাওয়া হলো দুজনকে। ক্যামিলার বাবার কাছে গেল ওদের ধরা পড়ার সংবাদ।
চাইলে উনিই পারতেন ওদের ক্ষমা করতে। সেই মতো গভর্নরের চিঠি এল। কিন্তু তিনি ক্ষমা করবেন
না। বংশমর্যাদায় যেভাবে ক্যামিলা কালি মাখিয়েছে, তিনি চান তাদের মৃত্যু। মায়ের আকুতি
এতোটুকু টলাতে পারলনা। খবর গেল জেলে। সেই মতো জেলার জানিয়েও দিল তাদের মৃত্যুদন্ডের
খবর। ফাদার অনুনয় করলো জেলারের কাছে, একবার যেন সে ক্যামিলার সঙ্গে দেখা করতে
পারে। অনুমতি পাওয়া গেলনা।
একইরকমভাবে ক্যামিলাকেও জানানো হলো মৃত্যু পরোয়ানার কথা। শুনে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। ডাক্তার
পরীক্ষা করে জানালেন ক্যামিলা প্রায় আট মাসের অন্তসত্বা। কোনো অন্তসত্বা নারীর মৃত্যুদন্ড
বে-আইনি। জেলার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের চিঠি নিয়ে পাঠালো ক্যামিলার বাবার কাছে, ভায়া
গভর্নর। কিন্তু এতেও টলানো গেলনা পাষণ্ড বাবাকে। বংশমর্যাদায় এতটাই উন্মত্ত, মেয়ের
আট মাসের সন্তান সহ মেয়ের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করতে এতটুকু হাত কাঁপল না!
ফায়ারিং
স্কোয়াডে যেদিন ক্যামিলা আর ফাদার লাডিসলাওকে আনা হলো, জেলে আসার পর সেই প্রথম ও শেষ
বারের মতো দুজন দুজনকে দেখল। তবে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। মুহূর্তেই দুজনের
চোখে বেঁধে দেওয়া হলো কালো কাপড়।
বিউগল বেজে উঠল। ফায়ারিং স্কোয়াডে বন্দুকধারীরা পজিশন নিল, এবং অর্ডার পাওয়া মাত্রই
গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল ফাদার লাডিসলাওকে। আর্তনাদ করে উঠল ক্যামিলা। এবার বন্দুকধারীরা
তাক করলো ক্যামিলার দিকে। কমান্ডার 'ফায়ার' বলে অর্ডারও দিল, কিন্তু কারও বন্দুক থেকে
গুলি বেরলো না। বন্দুক নামিয়ে সবাই মাথা নত করলো। আসলে আট মাসের সন্তান সহ মা'কে কিছুতেই
মারতে চাইছিল না। বন্দুক নামিয়ে ওটাই ছিল তাদের নিরব প্রতিবাদ। কমান্ডার গর্জে উঠল,
নিজের পিস্তল তাক করল বন্দুকধারীদের দিকে। এবং আবার অর্ডার দিল, 'ফায়ার'!
ভেতরে মনুষ্যত্ব থাকলেও আসলে তো তারা বেতনভূক। মালিকের নির্দেশ পালন করতেই হবে!
আবার সবাই বন্দুক তুলে নিল, এবং কমান্ডারের নির্দেশ মতো গুলি চালাল। ক্যামিলার পেট,
বুক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল।
দুজনের
রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়েছিল পাশাপাশি। চ্যাংদোলা করে রাখা হলো একটা বড় কফিনে। পাশাপাশি
ক্যামিলা আর ফাদার লাডিসলাই। হয়তো এখানেই ওদের প্রেমের স্বার্থকতা। মরণের পরে
দুজনের পাশাপাশি থাকা সবার ভাগ্যে জোটে না!
১৮৪৮ সালের ১৮ আগস্ট মাত্র ২০ বছর বয়সে ক্যামিলা (Maria
Camila O'Goman Ximenez) ও ফাদার লডিসলাওকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছিল।
কলেজ
জীবনে দেখেছিলাম ওদের জীবন আধারে 'ক্যামিলা' ছবিটি। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে ক্যামিলা-র কথা।
শুধু প্রেমের জন্য যাদের জীবন দিতে হয়েছিল এভাবে!
0 comments:
Post a Comment