Saturday, 3 August 2019
অক্লান্ত কবিতার যাত্রা
‘কাচের সন্তান কাচ—এই কথা দেখা গেল আমাদের খবরকাগজে ।’
কাব্যগ্রন্থটির
প্রথম কবিতার লাইনটি শুরু হচ্ছে এইভাবে। ‘কাচের সন্তান কাচ’—
এই কথাটা কোন চিন্তার গভীর থেকে আলোর পথ ধরে উঠে আসেনি, তেমনটা হলে কাচের সন্তান ‘দৃশ্য’ কিংবা অন্যকিছু হতে পারত। কিন্তু সেই সন্তান ‘কাচ’
হয়েই জন্মাচ্ছে। যেমন, মানুষের সন্তান মানুষ, অন্য যেকোন প্রাণির সন্তান
তার নিজস্ব অবয়ব। কিন্তু ‘কাচের সন্তান কাচ’ তেমনটা নয়। তেমনটাই হয়তো বাইরে
থেকে, বর্ণনা থেকে, দৃশ্য থেকে মনে হয়,
কিন্তু অবচেতনের অন্ধকার থেকে দেখলে সন্তানটির জন্ম সম্পূর্ণ
অন্যভাবে। কাচকে তার সন্তানের জন্ম দিতে হলে টুকরো হতে হয় , নিজেকে
ভাঙতে হয় অসমান বিভিন্ন অগণন খণ্ডতে। কাচ তার এই গর্ভাবস্থার ভাঙনে জানতেও পারে না
কতখণ্ডে কতগুলো সন্তানের সে জননী হতে চলেছে। হতাশার এই বৈচিত্রময় ৫৬টি কবিতার
অন্ধকার জগতের জন্মসূত্র নিয়ে কবি বিনয় মজুমদার লিখেছিলেন যে কাব্যগ্রন্থ তার নাম ‘বাল্মীকির কবিতা’ । বইটির কবিতার মধ্যে যেমন স্থান
পেয়েছে গদ্য কবিতা, তেমনই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা অন্যান্য কবিতাও
। বিনয় মজুমদার তাঁর ছন্দের কবিতাগুলোকে মূলত ১৮ মাত্রায় লিখতেন। কিন্তু এই বইয়ের
পাণ্ডুলিপিতে যে সমস্ত কবিতা তিনি লিখেছিলেন তার অধিকাংশই ২২ কিংবা ৩৪ মাত্রার অর্থাৎ
মহাপয়ারে লেখা। মূলত কবিতাগুলোতে আছে স্পৃহা, আছে অতলান্ত প্রেমের
প্রতি কবিসত্তার যন্ত্রণা। কবি হিসাবে বিনয় একথা জানতেন, প্রেমের
সহজ প্রকাশ ও রোম্যান্টিক নির্যাস প্রেমকে সীমাবদ্ধ করে তোলে। সেই প্রেমে সত্যের
একাংশ নিযুক্ত হয়ে পড়ে সম্পর্কের অস্তিত্ব বজায় রাখার কাজে। বিনয় মজুমদার এই
কবিতাগুলোকে সেসব সহজ উপায় থেকে মুক্তি দিলেন, অনাবিষ্কৃত
রাখলেন তাদের আত্মকথনকে। ২৬টি কবিতা ‘কবিতার খসড়া’ নামে প্রকাশিত হয়েছে বইটিতে। কবিতাগুলো বইয়ের শুরুতে, মাঝে, এবং শেষে সাজিয়ে রাখা হয়েছে অন্য কবিতাদের
সঙ্গে। এই বইয়ে ছাপা ছোট ছোট গদ্যকবিতাগুলোর ক্ষেত্রে আমরা কোনরকম
স্পেস দেখতে পাই না। পাঠকের মনকে আগে থাকতেই প্রস্তুত করেছে কবি, অর্থাৎ তৈরি করেছে এমন এক অক্লান্ত পাঠ যা কবিতাগুলোকে এক নিঃশ্বাসে পড়ে
ফেলতে মানুষকে বাধ্য করবে।
‘প্রত্যেকের এইরূপ
ব্যক্তিগত ঈশ্বর রয়েছে
এবং নারীরা
তাকে চাক্ষুষ দেখাতে পারে, দেখিয়েও থাকে।’
ঈশ্বরের অস্তিত্ব
এই দুটি লাইনে নড়ে ওঠে। কোন ব্যক্তিপুরুষ, যিনি নারীর আড়ালে নারীর
দ্বারাই বেড়ে ওঠে, কবি তাঁকে টেনে আনলেন। এই অধিকার তিনি
পেয়েছেন কবিতার সেই দুর্লভ অঞ্চল থেকে যেখানে নিহিত সত্যের জন্য কবিকে একাই পাপের যাত্রায়
ব্রতী হতে হয়। বাল্মীকি তো আসলে দস্যু রত্নাকর, একজন পাপী,
তার মতো করেই কবি সৃষ্টিকে অমোঘ নিয়তি থেকে নিরন্তর চুরি করেন,
এবং কবিতায় পরিণত করে নিজে হয়ে বসেন অত্যাচারী রাজা। পৃথিবীতে আজ আর
কোন সৎ কবির প্রয়োজন নেই একথা স্বীকার করে নিয়েছেন বিনয়। কেননা কবিকে বেরিয়ে পড়তে
হবে অনুসন্ধানে, পৌঁছতে হবে সত্যিকারের ছবির জগতে। ব্যর্থতা
এই যে, বইটি শেষ হচ্ছে একটি হতাশা ও অতৃপ্ত সঙ্গত কামনা দিয়ে।
কেননা, বাল্মীকি জানে না তাঁর পাপের বোঝা কে বয়ে বেড়াবে!
কবিও কি জানে সেকথা?
বইটির প্রথম
প্রকাশ ১৩৮৩ শ্রাবণ এবং ১৪১০ মাঘে(২০০৪) বইটি প্রথম
দে’জ পাবলিশিং কর্তৃক সংস্করণ হয়।
কবি বিনয়
মজুমদার তাঁর এই অব্যর্থ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করে
গিয়েছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে।
বাল্মীকির
কবিতা
বিনয়
মজুমদার
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment