Saturday, 3 August 2019
পরিধির জীবন কিংবা কিছু ক্রিকেটীয় কিস্সা
এ পৃথিবীর ভিতর আছে কিছু আশ্চর্য কুঠুরি। যার জন্য কোনও ডাকটিকিট নির্দিষ্ট নেই। নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে ঘোষণা সেখানে নীল খাম হয়ে পৌঁছায় না। ক্ষমতা ও প্রাতিষ্ঠানিকতার চাপে পড়ে দুমড়ে-মুচড়ে সরে যাওয়া সেই পরিধির জীবন কেউ-কেউ মাত্র ছুঁয়ে দেখতে পারেন। কেন্দ্র থেকে, কেন্দ্রীয় জীবনের অশ্লীল উদ্যাপন থেকে অনেক দূরে থাকা সে পৃথিবীর কর্নেলদের সচরাচর কেউ চিঠি লেখে না। দৈবাৎ কেউ নামিয়ে ফ্যালেন দোয়াত-কলম। আমরা খুঁজে পাই মাল্যবানদের।
আমরা চিনতে শিখি শান্তিকল্যাণ।
আবেশদা, আবেশ কুমার দাসের ‘বাইশ গজের কিস্সা’ পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, এ বই আসলে সেই পরিধির জীবনেরই কিস্সা শোনাতে বসেছে। কেন্দ্র অথবা অথরিটি যাদের পরিধির দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাদের অনেক নাম হতে পারে। অথবা যে-কোনও একটা নাম দেওয়া যেতে পারে। কিংবা নয় নাম নাই-ই থাকল। এইসব চরিত্রদের উপর যেন পড়েছে জীবনানন্দের নায়কদের ছায়া। সে ছায়া ক্রমশ দীর্ঘতর হয়। বিস্ময় জাগে। এবং আবিষ্কার করি, সেলফ রেফারেন্সিয়াল ধর্মীয় কোনও উপন্যাসের নামই যেন জীবন। যা পড়ে থাকে হেমন্তের কুয়াশা মেখে। অথবা কাউ কর্নারে, প্রায় অলক্ষ্যে। অথচ তা তো জীবনই। সোনালি মেঘে বিদ্যুৎরেখার মতো মিলিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে যে জীবন বেঁচে থাকে। তবু বেঁচেই তো থাকে। নাকি থাকে না! আমরা যেভাবে স্থির সিদ্ধান্তে আজও আসতে পারিনি যে মাকা বেঁচে আছেন, না মিলিয়ে গিয়েছেন। অদ্ভুত ঘটনা। আরও অদ্ভুত হল এই বিনোদন-ক্রিকেটের চড়া ককটেলে, এই এত আলোর মাঝে, পুঁজি নিয়ন্ত্রিত এত উচ্ছ্বাসের ভিতর একজন ইব্রাহিম সুলেমান মাকা যে স্রেফ ‘নেই’ হয়ে যেতে পারে, এ আমাদের ফিরিয়ে দেয় ওই পরিধিটির দিকে। মনে করিয়ে দেয়, কেন্দ্রীয় জীবন, বস্তুত জীবনের যে সংজ্ঞা দেয় তা আসলে অধিভাষার নমুনা মাত্র। এইটেই এই বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র। অনেক গল্প ফিরে এসেছে। উঠে এসেছে অনেক স্বল্পকথিত ইতিহাস। অনেক বঞ্চনা অথবা মহত্ত্বের কীর্তি যা আজকের মিডিয়াশাসিত সময়ে প্রশ্রয় পায় না। কিন্তু লেখকের উদ্দিষ্ট সেইসব প্রহরগুলোকেই বাঁচিয়ে তোলা, যেখানে দুরন্ত গতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জমা হচ্ছে ঠিক ব্যাটের মাঝখানে। কিংবা জন্ম হচ্ছে নীল রক্তের জিনিয়াসের। তা বাণিজ্যশাসিত হতে পারে না। খুবই সঙ্গত তাই এই সিদ্ধান্ত, ‘হারজিতের মামুলি বিচারে বরাবর এগিয়ে থাকে কমার্স। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ অস্তিত্ববান হয়ে উঠে এভাবেই আপন অমরত্বের প্রমাণ রেখে যায় রোমান্স।’ কীভাবে? তারই স্মারক ছড়িয়ে আছে বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে। সুব্রত ব্যানার্জি হোক বা এলিস আচং-এর কাহিনি—আমরা প্রবেশ করি গ্লসি ক্রিকেট-পৃথিবীর ভিতর থাকা সেই আশ্চর্য দুনিয়ায়, যা বড়ো রহস্যময়। আমাদের মনে পড়ে, পরিবর্তদের পারফরম্যান্স তাদের ব্যক্তিগত সাফল্যের পরিসংখ্যানে যোগ হয় না।
আসলে চরিত্র ধরে ধরে গল্প বলতে বলতে, জীবনের সঙ্গে ক্রিকেটকে মেলাতে মেলাতে, বিশুদ্ধ টেস্ট ক্রিকেটের রোমান্স, নোবেলেস্ট গেমের মাহাত্ম্য ধরিয়ে দিতে দিতে লেখক যখন এগোন, একটা সময় আমরা বুঝি আসলে তিনি বলতে চাইছেন স্বয়ং ক্রিকেটেরই প্রান্তিকতার কথা। ‘আসলে সাবেক ক্রিকেটের অন্তরঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে এমনই কিছু কিছু গভীর অনুষঙ্গ– যার অনুপস্থিতিতে কিছুতেই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না বৃহত্তর ক্রিকেটের অন্তরাত্মাকে।’
আমরা বুঝি এক তুমুল বিনোদনী সময়ে বসে ‘বাইশ গজের কিস্সা’ আসলে চাইছে সেই অন্তরাত্মাকেই ছুঁয়ে থাকতে। কে না জানে আত্মার বিনাশ নেই! অতএব খুঁজে দেখতে দোষ কী!
বাইশ গজের কিস্সা/ আবেশ কুমার দাস/ বেঙ্গল
ট্রয়কা পাবলিকেশন/ ১৪৬ টাকা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment